গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন - করণীয়, প্রতিকার, ঔষধ, চিকিৎসা
গরুকে এলএসডি থেকে বাঁচাতে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ হলে করণীয় ও গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিস এর চিকিৎসা সম্পর্কে থাকছে বিস্তারিত।
গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ অত্যন্ত ভয়ানক একটি ব্যাধি। এ রোগে গরুর ভালোভাবে চিকিৎসা না নিলে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রায় ৮০%। তাই লক্ষণ অনুযায়ী অবশ্যই আমাদের উচিত গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ এর সঠিক চিকিৎসা দেওয়া।
পোস্ট সূচিপত্রঃ গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন - গরুর লাম্পি রোগের লক্ষণ
.
ভূমিকাঃ
খামারিদের খামার ধসের মূল কারণ হলো রোগ ব্যাধি। এরমধ্যে ভয়ানক রোগ গুলোর মধ্যে হ্মুরা রোগে বেশি ক্ষতি হয়। কিন্তু বর্তমানে হ্মুরা রোগের চাইতে অধিক গরু মারা যাচ্ছে ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) আক্রান্ত হয়ে। অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে এ রোগ দেখা গেছে। কিন্তু তখন এ রোগের এতটা প্রকোপ ছিল না।
মহামারী আকার ধারণ করে ২০২১ সাল থেকে। ২০২৩ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে সবচাইতে বেশি গরু মারা যায়। দেখা দেয় বড় বড় খামারীদের ধসের চিত্র। খামারিদের চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিকিৎসা বিষয়ে সচেতন না হওয়া সাধারণ মানুষেরা। যারা গ্রামীন পরিবেশে বাড়িতে গরু পালন করত সবচাইতে তাদের গরু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৩ সালে প্রতি আক্রান্ত ১০০ টি গরুর মধ্যে ৪০ গরু মারা গেছে।
২০২৪ সালে পুনরায় এ রোগের প্রকোপ শুরু হয়েছে। কিন্তু পূর্বে থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধি করলে আশা করি গত বছরের তুলনায় এ বছর মহামারী আকার ধারণ করতে পারবেনা। তাই খামারিদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদেরও এ রোগ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাই এই রোগ দেখা দেওয়ার পূর্বেই গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন ও সঠিকভাবে গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ এর চিকিৎসা করুন।
গরুর লাম্পি রোগ
গরুর ল্যাম্পি রোগ অত্যন্ত মহামারী একটি রোগ। এ রোগের নাম শুনলেই খামারি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ও আতকে ওঠে। এ রোগে অধিক সংখ্যক গরু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালে এ রোগের প্রকোপের কারণে গরুর বাজারে ধ্বসের সৃষ্টি হয়। এটি একটি ভাইরাস সংগঠিত রোগ। তবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গরুর ল্যাম্পি রোগকে দূর করা সম্ভব।
এই রোগটি প্রতি বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এর প্রকোপ সবচাইতে বেশি দেখা যায়। তাই প্রতি বছরে মার্চ মাসের শেষের দিকেই গবাদি পশু গুলোকে এ রোগের ভ্যাকসিন করা প্রয়োজন। এ রোগে আক্রান্ত হলে গরু দুর্বল হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। সঠিকভাবে চিকিৎসা না নিলে গরু মারা যায়।
গরুর লাম্পি ভাইরাস
চিকিৎসকদের মতে ল্যাম্পি স্কিন ডিজিস (LSD) একটি ভাইরাস জনিত সমস্যা। এ রোগ ভাইরাসের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। এর বাহক হিসেবে মশা ও মাছি অন্যান্য কীটপতঙ্গ দায়ী। অসুস্থ গরু থেকে সুস্থ গরুকে আক্রমণ করার জন্য ভাইরাস দায়ী। গরুর ল্যাম্পি ভাইরাস একটি গরু থেকে অন্য গরুতে যেভাবে ছড়ায় নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ
- আক্রান্ত গরু সুস্থ গরুর সংস্পর্শে থাকলে
- আক্রান্ত গরুর খাবার সুস্থ গরু খেলে
- আক্রান্ত গরুর ঘরে সুস্থ গরু রাখলে
- আক্রান্ত গরুর মশা মাছি সুস্থ গরুকে কামড়ালে
- আক্রান্ত গুরুর লালা সুস্থ গরুর খাবারে মিশলে
- আক্রান্ত গরুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত সুচ সুস্থ গরুকে ব্যবহার করলে
- একই এলাকায় অন্য খামারে এ রোগের দেখা দিলে
- আক্রান্ত গরুর দুধ বাছুরে খেলে
- আক্রান্ত গরুর সিমেন সুস্থ গরুতে ব্যবহার করলে
- আক্রান্ত গরু পরিচর্যা শেষে একই পোশাকে সুস্থ গরুর পরিচর্যা করলে
উল্লেখিত ভাবে ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ এর ভাইরাস এক গরু থেকে অন্য গরুকে আক্রমণ করে। তাই এ রোগের মূল সচেতনতা হলো কোনভাবেই আক্রান্ত গরুর কোন কিছুই সুস্থ গরুকে খাওয়ানো বা ব্যবহার করা যাবে না। একটি খামারে একটি গরু আক্রান্ত হলে দ্রুত আক্রান্ত গরু সুস্থ গরু থেকে আলাদা করুন।
গরুর লাম্পি রোগের লক্ষণ
গরু ল্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তুলনামূলক ভাবে বড় গরুর চাইতে ছোট গরু আক্রান্ত হলে গরু বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। এ রোগটি অত্যন্ত মহামারী একটি রোগ। গরু ল্যাম্পি রোগে আক্রান্ত হলে যে লক্ষণ গুলো দেখা যায় তাহলঃ
- গরুর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়
- গরুর দুই চোখ দিয়ে পানি পড়ে
- গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোঁড়ার মতো ফুলে যায়
- ভুলে যাওয়া স্থান দিয়ে রক্ত, পূজ, পানি বের হয়
- গরুর খাবার খাওয়া কমে যায়
- গরু সব সময় ঝিমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
- গরু শুকিয়ে যায়
- আক্রান্ত স্থানগুলো মুখ দিয়ে চাটতে থাকে
- ফুলে যাওয়া স্থানের চামড়া খসে পড়ে
- গরুর মুখ দিয়ে লালা ঝরে
- গরুর পা ফুলে যায়
- গরুর দুই পায়ে পানি জমা হয়
- দিন দিন ক্ষতর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়
একটি গরু ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ এ আক্রান্ত হলে উপরোক্ত এই সমস্যা গুলো দেখা দেয়। এ রোগ প্রতিকারের জন্য গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন পূর্বে থেকেই ব্যবহার করুন। উল্লেখিত লক্ষণ গুলো দেখা মাত্র দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন
গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগের নির্দিষ্ট কোন ভ্যাকসিন নেই। তবে অন্যান্য দেশে এর ভ্যাকসিন রয়েছে। বাইরের দেশের ভ্যাকসিনের দাম অনেক বেশি হওয়ায় তুলনামূলক ভাবে আমাদের দেশে এই ওষুধগুলো পাওয়া যায় না। তবে ২০২৩ সাল অনুযায়ী গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগের বিভিন্ন ভ্যাকসিন মার্কেটে এসেছে। গরুর লাম্পি স্কিন রোগের চিকিৎসায় যে ভ্যাকসিনগুলো ব্যবহারিত হয় তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলঃ
- Rofique medicine Lumpyvac
- Bovivax LSD-N
- LSD-N DOLL
উল্লেখিত এই ভ্যাকসিন গুলো আমাদের বাংলাদেশ বিভিন্ন ভেটেনারি ফার্মেসিতে পাওয়া যাচ্ছে। এবং এই ভ্যাকসিন গুলোর মাধ্যমে ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আপনি এই ভ্যাকসিন গুলোর মধ্যে থেকে যেকোনো ভ্যাকসিন LSD এর চিকিৎসায় ব্যবহার করতে পারেন। আশা করি গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেয়েছেন।
গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর চিকিৎসা
অনেকে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ গরুর চর্ম রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে চাই। এ রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই তবে গরুর লক্ষণ আক্রান্ত স্থান অনুযায়ী গরুকে চিকিৎসা করা হয়। এটি যেহেতু ভাইরাস জনিত রোগ তাই গবাদি পশুর আবাসস্থল সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিয়মিত গবাদি পশুর ঘর স্যাভলন মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
অথবা যেকোনো জীবাণু নাশক দিয়ে ঘর পরিষ্কার করুন। গরুকে নিয়মিত কাঁচা ঘাস খাওয়ান। নিয়মিত কাঁচা ঘাস খাওয়ালে পশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। গরুকে দুই থেকে তিন মাস পর পর জিংক ভিটামিন খাওয়ান এতে গরুর সকল ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। গরুর শরীরে তাপমাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করুন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে প্যারাসিটামল অথবা নাপা এক্সট্রা খাওয়াতে পারেন। প্রতিবছর মার্চ মাসে আপনার গরুকে ল্যাম্পি স্কিন ডিজিস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দিন।
গরুর লাম্পি রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা
গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি আক্রান্ত গরুর কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা করুন এতে আপনার গরু দ্রুত সুস্থ হবে। আক্রান্ত গরুকে সুস্থ গরু থেকে আলাদা করে রাখুন। অসুস্থ গরুকে আলো পর্যাপ্ত পরিমাণ বাতাস আছে এ রকম স্থানে রাখুন। অবশ্যই আক্রান্ত গরুকে মশারির ভিতরে রাখবেন।
সুস্থ গরুর চাইতে আক্রান্ত গরুর বেশি বেশি পরিচর্যা করুন। ক্ষতস্থান গুলোতে দিনে দুই থেকে তিনবার বালি গরম করে শেক দিন। আক্রান্ত স্থান থেকে যদি রক্ত, পুজ অথবা কষাণী বের হয় সেক্ষেত্রে ওই স্থান গুলোতে হলুদ গুঁড়ো লাগিয়ে দিন। ক্ষতস্থান গুলোতে যদি মশা মাছি বসে তাহলে ওই স্থান গুলোতে কাঁচা রসুন থেঁতো করে সরিষার তেলের সাথে মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিন। এতে মশা মাছি পড়া রোধ হবে।
গরুর লাম্পি রোগের ঔষধ
গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগের নির্দিষ্ট কোন ঔষধ নেই। লক্ষণ অনুযায়ী এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। শরীরে ঘা দেখা দিলে, ঘা ফেটে গেলে, ঘা শুকানোর ঔষধ দেওয়া হয়। অন্যদিকে শরীরের ক্ষতস্থান যাতে বৃদ্ধি না পাই সেজন্য স্প্রে ব্যবহার করতে হয়। আক্রান্ত পশুকে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা ও ঔষধ দেওয়া হয়।
গরুর লাম্পি রোগের হোমিও চিকিৎসা
গরুর লাম্পি রোগের এলোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসা করা হয়। এলোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসায় ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ দূর করা যায়। এলোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসা করলে দ্রুত গরুকে সুস্থ করা যায়। হোমিও চিকিৎসায় ব্যবহারিত কিছু ওষুধের নাম নিচে দেওয়া হলঃ
- Variolinum- 30/200
- Silicea- 30/200
- Malandrinum- 30/200
- Acid chryso- 200
- Guaiacum- 200
- Antim crud- 200
এই ওষুধগুলো ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ গরুর লক্ষণ অনুযায়ী আক্রান্ত গরুকে সেবন ও ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। তবে ঔষধ গুলো ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই একজন হোমিও রেজিস্টার্ড কৃত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করুন।
গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিস রোগের প্রতিকার
গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ LSD রোগের প্রতিকার করার জন্য অবশ্যই পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। এ রোগের চিকিৎসার জন্য সচেতন হওয়া উচিত। প্রতি বছরে এই রোগ হওয়ার পূর্বের সময় মার্চ মাসে আপনার গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন প্রদান করুন। গরু যদি আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে অসুস্থ গরু সুস্থ গরু থেকে আলাদা রাখুন।
অবশ্যই গরুর ঘর জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন। অবশ্যই গরুকে মশা মাছির কামড় থেকে দূরে রাখার জন্য মশারি দিন। আক্রান্ত গরুকে আলাদা করে অন্য জায়গায় মশারি টাঙিয়ে রাখুন। রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেলে ভালো কোন রেজিস্টার্ডকৃত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখকের মন্তব্য
অনেকে গরুর লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন ও গরুর লাম্পি রোগের লক্ষণ সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আজকের আর্টিকেলটি তাদের উদ্দেশ্যে লেখা। আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবেন। এছাড়া গরুর ল্যাম্পি হলে করণীয়, প্রতিকার, ঔষধ, চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
আর্টিকেলটি যদি ভালো লাগে তাহলে প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন। নিয়মিত এ রকম আর্টিকেল পেতে আমাদের সাইটটি ভিজিট করুন। এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।